গল্পঃ ভালবাসার বৃষ্টি


সকাল বেলা।

বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে।জামিল সাহেব বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন।মাঝে মাঝেই বৃষ্টির ঝাপটা এসে জামিল সাহেবকে ভিজিয়ে দিচ্ছে।জামিল সাহেব তাতে বিরিক্ত হচ্ছেন বটে, তবে বারান্দা থেকে উঠে যাচ্ছেন না।সকালবেলা বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়া তার বহুদিনের অভ্যাস, নিতান্ত বাধ্য না হলে তাই বারান্দা ছেড়ে কখনও পত্রিকা নিয়ে অন্য কোথাও যান না।

অবশ্য সকালবেলায় বারান্দায় বসার অন্য অনেক সুবিধাও আছে।একা একা বারান্দায় বসেই তিনি প্ল্যান করে নেন সারাদিনে কি কি করবেন, কিভাবে পুরো দিনটা কাটাবেন।অফিসে গেলেই বসের ঝাড়ি আর বাসায় থাকলে স্ত্রীর প্যানপ্যানানির কারনে কখনোই নিজের ইচ্ছামত কিছু করা হয়না, তাদের কথামতই সব করতে হয়। এর বাইরে সকালবেলা ফ্রেশ মুডে নিজের ইচ্ছেমত দিনটাকে প্ল্যান করা, সেটার বাস্তবায়ন হোক আর না-ই হোক-ভাল লাগে, বেশ ভাল লাগে।

হঠাৎ হোসনে আরার ডাক শুনতে পেলেন তিনি, কোথায় তুমি? খেতে এসো।

জামিল সাহেব বারান্দা থেকেই জানতে চাইলেন, বাবুরা খেতে বসেছে?

বাবুরা মানে জামিল সাহেব ছোট দুই ছেলেমেয়ে সামীন আর সামীহা।সামীন ক্লাস সেভেনে- কলেজিয়েট স্কুলে আর সামিহা সিক্সে-খাস্তগীর স্কুলে।


হোসনে আরা জবাব দিলেন, হ্যা, ওদের খাওয়া প্রায় শেষ।তুমি তাড়াতাড়ি খেতে এসো। খেয়ে আবার ওদেরকে স্কুলে দিয়ে আসতে হবে।

জামিল সাহেব পত্রিকা ভাজ করে খাওয়ার ঘরে এলেন। চেয়ারে বসতে বসতে স্ত্রীর কাছে কানতে চাইলেন, সাবিহা কোথায়?

সাবিহা জামিল সাহেবের বড় মেয়ে। এখন পড়ছে মহসিন কলেজে-ফার্স্ট ইয়ারে।

হোসনে আরা জবাব দিলেন, কোথায় আবার? নিজের ঘরে।

কি করে?

পড়ছে।

আজও কি তার স্যারের বাসায় কোচিং আছে?

হ্যা, আছে। বাবুদের জলদি স্কুলে দিয়ে এসো।এরপর সাবিহাকে ওর স্যারের বাসায় নামিয়ে দিতে হবে।

আজকে কোন স্যার?

ফিজিক্স মনে হয়। ওকে জিজ্ঞেস করে দেখো।আমার এত স্যারের রুটিন মনে থাকে না।

আমি বুঝিনা এই পোলাপানগুলার স্যারের বাসায় গিয়ে কি এত পড়া লাগে।আমরাওতো ভাই ম্রেট্রিক-ইন্টার পাশ করে আসছি। আমাদেরতো এত স্যারের বাসায় দৌড়াদৌড়ি করা লাগে নাই।

যুগ বদলাইছে না। তোমার আমার যুগে ফার্স্ট ডিভিশান পাইলে সবাই মাথায় তুলে নাচত।এখন ৬০% মার্কস পেয়ে বল আমি ফার্স্ট ডিভিশান পাইছি, কেউ পাত্তাও দিবে না।

জামিল সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।আসলেই দিন বদলে গেছে, অনেক বদলে গেছে।তাদের সময় ফার্স্ট ডিভিশান পাওয়াই রীতিমত কঠিন ব্যাপার ছিল আর এখন যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই এ+।৮০% নম্বর পাওয়া কি এতই সোজা হয়ে গেল? নাকি তাদের সময়ে সবাই গর্দভ ছিল?

হোসনে আরা বললেন, যাও,মেয়েকে জিজ্ঞেস কর আজকে কোন স্যারের বাসায় পড়তে যাবে।তোমাকেই কিন্তু নামিয়ে দিয়ে আসতে হবে।

হোসনে আরা রান্না ঘরে চলে গেলেন।

জামিল সাহেব জানতে চাইলেন, সাবিহা, আজকে তোর কোন স্যার?

ফিজিক্স, আব্বু।সাবিহা নিজের ঘর থেকে জবাব দিল।

কয়টা থেকে?

নয়টা।

জামিল সাহেব ঘড়ির দিকে তাকান।সাড়ে সাতটা বাজে। পিচ্চি দুটোর ক্লাস আটটা থেকে। ওদের এখনই পৌছে দিতে হবে, এরপর ফিরে এসে আবার সাবিহাকে নামিয়ে দিতে হবে।তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করতে হবে।

হঠাৎ কলিংবেল বেজে ওঠে।জামিল সাহেব উঠে দরজা খোলেন।

সাকিব দাঁড়িয়ে।

সাকিব।জামিল সাহেবের বড় ছেলে।বুয়েটে পড়ে।থাকে হলে।

ছেলেকে দেখে জামিল সাহেব অবাক হয়ে যান।তুই? এসময়?

খালি প্রশ্ন করবেন নাকি ঘরে ঢুকতে দিবেন?

ওহ, হ্যা,হ্যা। আয়, ভেতরে আয়।

জামিল সাহেব দরজা থেকে সরে দাড়ান।সাকিব ব্যাগ নিয়ে ভেতরে ঢোকে।

হোসনে আরা ভেতর থেকে প্রশ্ন করেন, কে এল?

সাকিব।

শুনেই হোসনে আরা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।

কখন এলি বাবা? বলতে বলতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন।

এইতো আম্মু, এখনই।

পুরাইতো ভিজে গেলি।

বাইরে যে ভয়ানক বৃষ্টি। না ভিজে উপায় আছে?

দাড়া। তোয়ালে নিয়ে আসি।

হোসনে আরা ভেতরে চলে যান।

সামিহা আর সামিন এসে দাড়িয়েছে।একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সাকিবের সাথে ওদের বয়সের পার্থক্য একটু বেশী।তাই ভাইয়ের সাথে যতটা ওদের ভালবাসা আর দুষ্টুমীর সম্পর্ক, তারচেয়ে অনেক বেশী শ্রদ্ধার সম্পর্ক।

সাকিব ওদেরকে ইশারায় কাছে ডাকল।দুজনই একসাথে ছুটে এল।কারন ওরা জানে ভাইয়া ওদের জন্য চকলেট নিয়ে এসেছে।গত চার বছর ধরে এটাই অলিখিত নিয়ম হয়ে আছে।যখনই সাকিব বাসায় আসে, প্রতিবারই পিচ্চি দুটোর জন্য চকলেট নিয়ে আসে।

এবারও কোন ব্যতিক্রম হল না। দুজন ছুটে আসতেই সাকিব ওদের হাতে চকলেট ধরিয়ে দিল।চকলেট নিয়ে দুজন আবার দৌড় দিল ঘরের ভেতর।

সাকিব আর জামিল সাহেব ভেতরে গিয়ে বসলেন। হোসনে আরা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছিয়ে দিলেন সাকিবের।

কেমন আছিসরে ব্যাটা? হোসনে আরা জানতে চাইলেন।

আমি ভাল আছি আম্মা।সাকিব হাসল।

কিছু খাইছস?

সাকিব মাথা নাড়ে।খিদায় পেট চো চো করে গো মা।

দাড়া। খাবার নিয়ে আসছি।হোসনে আরা আবার রান্নাঘরে।

সাকিব।জামিল সাহেব ডাকলেন।

জ্বি আব্বু।

হঠাৎ কোনরকম খবর না দিয়েই চলে আসলি? কোন সমস্যা হইছে?

সমস্যা মানে?

মানে আবার বিশ্বকাপের মত হল ভ্যাকেন্ট খাইলি নাকি?

আরে না আব্বা।ক্লাস শেষ হইছে। পিএল শুরু হইল।অনেকদিন আপনাদের দেখি না। তাই ভাবলাম একটু ঘুরে যাই।

ক্লাস শেষ?

হ্যা।

পরীক্ষা কবে?

দেরী আছে।রুটিন দিবে, পিছাবে, আবার রুটিন দিবে।মিনিমাম এক মাস লাগবে পরীক্ষা শুরু হইতে।

তোরা দেশের সেরা ছাত্র। কি যে করিস এসব?

আমরা আবার কি করি?আমরা কিছুই করি না। মিছিল-মিটিং যা কিছু তা ওই গুটিকয় পোলাপাইনই করে।আমরা শুধুই দেখি।দেখার চেয়ে বেশী কিছু করার হ্যাডম আমাদের নাই।

ছেলের মুখে এমন জবাব শুনে জামিল সাহেব অবাক হয়ে যান।ছেলেটাতো কখনো এভাবে কথা বলত না। তবে কি ছেলে বুয়েটে পড়ে হতাশ হয়ে পড়ল?

সাকিব।

জ্বি।

তোড় কয়টা সেমিস্টার গেল?

এটা গেলে ফোর ওয়ান শেষ হবে। মানে সাতটা।

চার বছরে সাতটা?

হ্যা।

তার মানে ইতিমধ্যে ছয় মাস লস?

হ্যা।

জামিল সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।সাকিব চুপ হয়ে যায়।

ইতিমধ্যেই হোসনে আরা নাস্তা নিয়ে চলে এসেছেন। খা বাপ।

সাকিব খেতে শুরু করে।

হলের খাবার দাবারের কি অবস্থা?ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন হোসনে আরা।

কি আর অবস্থা হবে? সাকিব খেতে খেতে জবাব দেয়।যেই লাউ সেই কদু।গত চার বছর যা খাইছি এখনো তাই খাচ্ছি।
হুম্ম। হোসনে আরা এবার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলেন, তুমি বসে আছ কেন? বাবুদেরকে স্কুলে দিয়ে আসতে হবে না? বৃষ্টি একটু কমছে। তাড়াতাড়ি দিয়ে আসো।এরপর আবার সাবিহাকেও ওর স্যারের বাসায় দিয়ে আসতে হবে।

সাবিহার নাম শুনে সাকিব বলে, সাবু কই? ওকে দেখিনা কেন?

আছে নিজের ঘরে।

ঐ সাবু।সাকিব ডাক দেয়।কই গেলি? আয়, একসাথে নাস্তা করি।

সাবিহা এসে দাড়ায়। কেমন আছ ভাইয়া?

এতক্ষন কই ছিলি?

পড়ছিলাম।

পরীক্ষা নাকি?

আরে নাহ, এমনিই। আমি কি আর বুয়েটিয়ান যে শুধু পিএলে পড়ব? আমাদের সারা বছরই পড়তে হয়।

তাই? ভ্রু নাচায় সাকিব।

জ্বি হ্যা।

এমন সময় জামিল সাহেব বললেন, সাবিহা দেখতো বাবুরা রেডী হইল নাকি?

আচ্ছা।

এমন সময় সামীন-সামীহা ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বলে, আজকে ভাইয়া আসছে অনেকদিন পর। আমরা আজকে স্কুলে যাব না।

এমন সময় সাবিহাও বলে উঠে, ঠিক ঠিক। আজকে আমিও স্যারের বাসায় যাব না। ভাইয়া আসছে আজকে

জামিল সাহেব চোখ রাঙ্গানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু তাতে কিছু হয় না।উল্টো সাকিব বলে ওঠে, থাক না আব্বু। একদিন মিস দিলে এমন কিছু হবে না।

হোসনে আরাও ওদের সমর্থন দেন।ফলে জামিল সাহেবের আর কিছু বলার থাকে না।বিল সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়ে যায়।আজকে নো স্যার, নো স্কুল।

সাবিহা বলে, ভাইয়া বাবুদের জন্য চকলেট আনছ আর আমার জন্য?

একটা জিনিস আনছি।

সাবিহা হাত বাড়িয়ে দেয়। দাও দেখি।

এখন না। দুপুরে।

এখন না কেন?

দুপুর, দুপুরে।ভাত-টাত খাওয়ার পর।সাকিব এবার হোসনে আরার দিকে ফেরে। আম্মু, দুপুরে খিচুড়ি আর ইলিশ করেন।অনেকদিন খাই না। এমন বর্ষার দিনে খুব খাইতে ইচ্ছা করে।

আচ্ছা।দাড়া, তোর আব্বুকে বলি। বাজারে যাইতে হবে।

সবাই খিচুড়ি আর ইলিশের কথা শুনে হইহই করে ওঠে।

ইতিমধ্যেই জামিল সাহেব পত্রিকা নিয়া আবার বারান্দায় চলে গেছেন।হোসনে আরা বারান্দায় গেলেন স্বামীকে বাজারের ফর্দ ধরিয়ে দিতে।

ধর।

জামিল সাহেব অবাক হয়ে বললেন, কি?

বাজারের ফর্দ?

কেন? গতকালই না বাজার করলাম।

ছেলে আবদার করছে ইলিশ দিয়ে খিচুড়ি খাবে।বাজার থেকে ইলিশ আর এই কয়টা জিনিস নিয়ে আসো।

জামিল সাহেব বাজারের লিস্টের দিকে তাকান আর পকেটে হাত দেন। সাথে সাথেই তার গলা শুকিয়ে যায়।

কি হল? হোসনে আরা জানতে চান।

কি আর হবে? চাকরিজীবী মানুষের যা হয়। মাসে শেষ চলতেছে, এখন কি আর ইলিশ কেনার টাকা পকেটে আছে? জামিল সাহেব মাথাটা নিচু করে ফেলেন।

তোমার কাছে সত্যিই টাকা নাই?

নিজের ছেলেমেয়েকে না খাওয়ায় কি আমি টাকা লুকায় রাখব?

দাড়াও।আসতেছি।

হোসনে আরা ভেতরে চলে যান

কোথায় যাও আবার?

হোসনে আরার কোন জবাব পাওয়া যায় না। জামিল সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে যায়। ছেলেটা তার অত্যন্ত বুঝদার, কখনো উলটাপালটা আবদার করে না। আজ যাও ইলিশ খাওয়ার আবদার করল, তাও তিনি পূরন করতে পারছেন না।হায়রে সরকারী চাকরী।

এমন সময় হোসনে আরা পাশে এসে দাড়ান।হাতে দুটো হাজার টাকার নোট।

ধর।

জামিল সাহেব অবাক হয়ে যান।তুমি কোত্থেকে টাকা পাইলা?

প্রতি মাসে আমি সংসারের খরচ থেকে কিছু টাকা বাচানোর চেষ্টা করি। সেই টাকা। অবাক হওয়ার কিছু নাই।

জামিল সাহেব অবাক চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকেন।ভালবাসায় তার চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে।

কি হল? উঠ। বৃষ্টি কমছে। সকাল সকাল বাজারে গেলে ফ্রেশ মাছ পাবা আর সস্তায়ও পাবা।তাড়াতাড়ি যাও।

হ্যা হ্যা। জামিল সাহেব উঠে দাড়ান। ছাতাটা দাওতো।

হোসনে আরা ছাতা আনতে ভেতরে যান।এমন সময় সাকিব বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।

বেরোচ্ছেন নাকি আব্বু?

হ্যা, একটা বাজারে যাব।এখন গেলে ফ্রেশ ইলিশ পাওয়া যাবে।

তাই নাকি? চলেন আমিও যাই।

না বাবা। তুই লম্বা জার্নি করে এলি, অনেক টায়ার্ড।একটু বিশ্রাম নে।

আরে ধুর। চার বছর ধরেই তো এই আসা-যাওয়ার মধ্যেই আছি। এ আর নতুন কি।চলেন যাই।

এবার সত্যিসত্যি জামিল সাহেবের চোখের কোন থেকে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরে।ছেলে বড় হয়েছে, বাবার দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নিতে চাইছে-এ কথা ভাবতেই আনন্দে তার মনটা ভরে যায়।

এমন সময় হোসনে আরা ছাতা নিয়ে আসেন। ছাতা হাতে নিয়ে জামিল সাহেব বলেন, চল, আজ বাপ ব্যাটা একসাথে 
বাজার করব।

জামিল সাহেব আর সাকিব বাজারে রওয়ানা দেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে হোসনে আরা আর সাবিহা তাদের চলার পথের দিকে চেয়ে থাকেন।ভালবাসার বৃষ্টি তাদের পুরো পরিবারকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়। 

ব্লগার আমি তুমি আমরা
Facebook: www.facebook.com/ami.tumiamara


==============================================


একটি আমি তুমি আমরা প্রোডাশন। কপি পেস্ট মারলে কিন্তু খবর করে দিব।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চট্টগ্রাম!চট্টগ্রাম!!চট্টগ্রাম!!!আসুন চট্টগ্রামের ভাষা শিখি ( সকল চিটাইংগা এবং নন-চিটাইংগার জন্য একটি অবশ্য পাঠ্য পোস্ট) ;););)

কিছু কমন কৌতুক (হাল্কার উপর পাতলা ১৮+)

একটি ফেসবুকীয় প্রেম কাহিনী ও কিছু ছ্যাকা খাওয়ার গল্প